...মাঝেমধ্যেই মাদ্রাসায়
নিয়ে আসা হতো−আমরা সুরা মুখস্থ
করতে করতে দেখতাম রোগীকে গাছের
সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে−আর সন্ধ্যার
পর চিকিৎসার নামে শুরু হতো অত্যাচার।
সব মিলিয়ে একেবারে ভয়াবহ ব্যাপার!
এক কোরবানির ঈদের ঘটনা। ঈদের
আগে মাদ্রাসায় ছুটি হয়েছে। মাদ্রাসার
সবাই চলে গেছে,
রয়ে গেছি খালি আমি আর মতিন।
মতিনের বাড়িতে কেউ নেই, রোজা-রমজান
বা ঈদের ছুটিছাটাতেও সে মাদ্রাসায়থাকে।
আমার বাড়ি অনেক দুর−গয়না নৌকার
সঙ্গে যোগাযোগ করে যেতে হবে, সে জন্য
দেরি হচ্ছে। হুজুর করিমুল্লার
বাসা মাদ্রাসার সঙ্গে লাগানো,
সেখানে হুজুর তাঁর দুই বিবি নিয়ে থাকেন।
সেই বিবিরা খুব পর্দানশিন।
আমরা কখনো দেখি নাই।পরপুরুষদের
মহিলাদের গলার আওয়াজ শোনা ঠিক না;
কিন্তু আমরাশুনতাম দুই বিবি ক্যাট
ক্যাট করে রাতদিন ঝগড়া করছে।
হুজুর
খেপে গিয়ে মাঝেমধ্যে তাঁর দুই
বিবিকে শাসন করতেন, সেটা ছিল
আরওভয়াবহ ব্যাপার।
একদিন হুজুর করিমুল্লা তাঁর এক
বিবিকে বাপের
বাড়িতে রেখে আরেকবিবিকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেছেন।
আমার আর মতিনের ওপর
পুরো মাদ্রাসার দায়িত্ব। হুজুর
ফিরেএলে আমরা বাড়ি যাব।
পুরো মাদ্রাসা খালি, গাছপালায়
ঢাকা পুরোনো দালান, দিনের বেলাতেই
অন্ধকার হয়ে থাকে। যখন অন্য
ছাত্ররা ছিল, ভয়ডর করে নাই; কিন্তু
একা কেমন জানি গা ছম ছম করে। মতিন
ছিল বদমাইশের ঝাড়, দিনরাত খালি জিন-
ভুতের গল্প করে ভয় দেখাত।
আমি যে দিনের কথা বলছি সে দিন
দুপুরবেলা দুরের কোনো একটা গ্রাম
থেকে দুইজন মানুষ
জিনে পাওয়া একটা রোগী নিয়ে এসেছে হুজুরের
কাছে। যখন শুনল হুজুর নেই, তখন
তারা একটু বিপদে পড়ে গেল
−রোগী নিয়ে থাকবে না চলে যাবে বুঝতে পারছে না।
আমরা জিন-ভুতের রোগী দেখে অভ্যস্ত।
রোগীগুলোর মধ্যে একটা মিল ...
...থাকে। সবাই কেমন যেন ভয়ের
মধ্যে থাকে, হাত-পা কাঁপে,
ভালো করে হাঁটতে পারে না, বিড়বিড়
করে কথা বলে হাউমাউ করে কাঁদে। কিন্তু
এই রোগীটা একেবারে অন্য রকম।
দেখে মনে হয় পুরো স্বাভাবিক। রোগীর
বয়স বেশি না, ২৩-২৪ বছর। গায়ের
রং ফরসা, মাথার চুলগুলো একটু লম্বা। ।
দেখেমনে হয় যাত্রাদলে অভিনয় করে।
পায়জামা আর শার্ট পরে আছে,
শরীরে একটা চাদর জড়ানো।
মানুষটা বেশি কথা বলে না,
কিন্তুকী রকম জানি মেরুদন্ড
সোজা করে শক্ত হয়ে বসে থেকে শুধু
এদিক-সেদিক তাকায়। চোখের
দৃষ্টিটা একটু অন্য রকম, চোখে চোখ
পড়লে কেমন জানি বুক কেঁপে ওঠে।
মতিন সঙ্গের মানুষ দুইজনকে জিজ্ঞেস
করল, ‘এই আপনাদের রোগী?’
মানুষ দুইজন মাথা নাড়ল। আমি বললাম,
‘দেখে তো কোনো সমস্যা আছে মনে হয়
না।’
আমার কথা শুনে রোগী দাঁত বের
করেহাসল, দাঁতগুলো লালচে দেখে কেমন
যেন অস্বস্তি লাগে। মতিন বলল,
‘রোগীর কোনো সমস্যা নেই। নিয়ে যান।’
আমি বললাম, ‘হুজুর আসবে পরশু
দিন,তখন আসবেন।’
সঙ্গের দুইজন মানুষ নিজেদের
মধ্যে বিড়বিড় করে কী যেন কথা বলে,
আমাদের কিছু বলে না। একটু পর
দেখি রোগীকে রেখে মানুষ দুইজন
পালিয়ে গেছে। আমি আর মতিন তখন
রোগীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম।
মতিন মানুষটাকে জিজ্ঞেস করল,
‘আপনার সঙ্গে দুইজনকই?’
মানুষটা তার লাল দাঁত বের করে হাসার
মতো ভঙ্গি করে বলল, ‘চলে গেছে।’
‘কোথায় চলে গেছে।’
‘মনে হয় বাড়ি চলে গেছে।’
‘আপনাকে রেখে বাড়ি চলে গেছে?’
মানুষটা মাথা নাড়াল। বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘কেন?’
‘ভয় পায় তো সেই জন্য।’
‘আপনাকে ভয় পায়?’
http://joshim.wapdale.com
‘হ্যাঁ।’
‘কেন? আপনাকে দেখে তো ভয় পাওয়ার
কিছু আছে বলে মনে হয় না?’
মানুষটা কোনো কথা না বলে এদিক-সেদিক
তাকাল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আছে?’
‘এখন নাই। তবে−’
‘তবে কী?’
‘রাতে যখন ও আসবে−’
‘কে আসবে?’
...‘ও।’
‘ও-টা কে?’
মানুষটা কথার উত্তর
না দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। মতিন
তখনএকটু রেগে উঠে বলল, ‘আপনি এখন
যান। আপনার সঙ্গে যারা আসছে তাদের
সঙ্গে বাড়ি যান।’
মানুষটা এমন একটা ভাব করল যেন
মতিনের কথা শুনতেই পায় নাই। মতিন
তখন গলা উঁচিয়ে ধমক দিয়ে বলল, ‘যান।
বাড়ি যান।’
মানুষটা মাথা নাড়ল। বলল, ‘নাহ্।যাব
না।’
‘যাবেন না?’
‘না।’
‘কেন যাবেন না?’
‘জায়গাটা ভালো, আমার পছন্দ হয়েছে।’
‘পছন্দ হয়েছে?’
‘হ্যাঁ। অন্ধকার, লোকজন বেশি নেই।
নিরিবিলি। ও যখন আসে,
লোকজনথাকলে রাগ হয়।’
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘ও-
টা কে?’
মানুষটা আমার কথার উত্তর দিল না।
চাদর মুড়ি দিয়ে চুপচাপ বসে রইল।
মতিন জিজ্ঞেস করল, ‘ও কেন আসে?’
‘খিদে পায় তো, তাই খেতে আসে।’
‘কী খায়?’
‘রক্ত খায়।’
শুনে আমরা দুইজনই চমকে উঠলাম, ‘রক্ত
খায়?’
মানুষটা তার দাঁত বের করে হাসল,
দাঁতগুলো লাল। এবারে আমার গা ঘিন ঘিন
করতে লাগল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিসের
রক্ত?’
‘যখন যেটা পায
গরু-ছাগল।’ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘মানুষ।’
আমি চিৎকার করে বললাম, ‘মানুষ?’
মানুষটা কোনো কথা না বলে আমার
দিকে তাকিয়ে থাকে, তার চোখের
দৃষ্টি দেখে আমার হাত-
পা ঠান্ডা হয়ে গেল।
আমি আর মতিন নিজেদের মধ্যে পরামর্শ
করতে বসলাম। মতিন বলল, ‘এই
লোকরে এইখানে রাখা যাবে না।’
আমি বললাম, ‘না। দিনের বেলাতেই
দেখে এত ভয় লাগে, রাতে কী হবে?’
মতিন বলল, ‘আজ আবার অমাবস্যা।’
আমি বললাম, ‘চল, মানুষটাকে বের
করে দেই।’
মতিন জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় বের
করে দিবি?’
‘ধরে নিয়ে বাজারে ছেড়ে দিব।’
আমার পরামর্শটা মতিনের পছন্দ হলো।
বলল, ঠিক আছে।
আমি আর মতিন তখন গেলাম
মানুষটাকে ধরে বের করে দিতে,
গিয়ে দেখি মানুষটা নেই।
চারদিকে গাছগাছালি, ঝোপঝাড়।
মাদ্রাসার ..
...ভাঙা দালানের মধ্যে কেউ
যদি লুকিয়ে থাকে, তাকে খুঁজে বের
করা অসম্ভব ব্যাপার। তবুও আমি আর
মতিন চেষ্টা করলাম, কোনো লাভ
হলো না।
রাতের
বেলা আমরা তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছি।
আলো কমিয়েহারিকেনটা মাথার
কাছে রেখেছি, ঘরের
ভেতরে আবছা অন্ধকার।
বাইরেঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে, গাছের পাতার
শরশর একরকম শব্দ হচ্ছে।
কাছাকাছি কোথা থেকে জানি শেয়ালডাকল,
চলবে..
কাছাকাছি কোথা থেকে জানি শেয়ালডাকল,
শেয়ালের ডাক খুব ভয়ের
−মনে হয়একটা খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
শেয়ালের ডাকটা শেষ হওয়ার
সঙ্গে সঙ্গে আমরা শুনলাম, উঁ উঁ
করে কে যেন কান্নার মতো শব্দ করছে।
প্রথমে আস্তে আস্তে, তার পরে একটু
জোরে। একটু পরে আরও জোরে।
আমি আর মতিন দুইজনেই তখন বিছানায়
উঠে বসলাম। মতিন জিজ্ঞেস করল,
‘কে? কে কাঁদে?
আমি বললাম, ‘ওই মানুষটা হবে নিশ্চয়ই।’
‘কোথায় আছে দেখবি?’
আমি বললাম, ‘যদি কিছু করে?’
‘কী করবে? আমরা দুইজন আছি না?’
সেটা অবশ্য সত্যি কথা, আমরা দুইজন,
পনেরো-ষোল বছর বয়স। গ্রামের ছেলে,
হাট্টাকাট্টা জওয়ান আমাদের কী করবে?
খুঁজে খুঁজে ঘরের ভেতর
থেকে দুইটা লাঠি বের
করে হারিকেনটা হাতে নিয়ে বের হলাম।
ঘর থেকে বের হতেই শব্দটা থেমে গেল।
একটু পরে আবার শুরু হলো।
প্রথমে আস্তে, তার পরে একটু জোরে।
শব্দটা শুনতে শুনতে আমরা এগিয়ে যাই,
দালানটার শেষ মাথায় একটা ছোট ঘর,
পুরোনো বই-খাতা জঞ্জাল দিয়েভরা,
মনে হচ্ছে শব্দটা সেখান থেকে আসছে।
আমরা ঘরটার
দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকে একেবারে হকচকিয়ে গেলাম।
ঘরের জঞ্জাল পরিষ্ককার
করে সেখানে সাদা চাদরটা বিছিয়ে মানুষটা উদোম
হয়ে শুয়ে আছে−দুই হাত, দুই
পা লম্বা া করে ছড়িয়ে রেখেছে। তার মুখ
ঘামে ভেজা আর সেখান থেকে কান্নার
মতো শব্দ বের হচ্ছে।
মতিন জিজ্ঞেস করল, ‘কী হচ্ছে?
কী হচ্ছে এখানে?’
মানুষটা ভাঙা গলায় বলল, ‘ভয় করে।
আমার ভয় করে।’
‘কী ভয় করে?’
‘ওরে ভয় করে।’
‘কেন ভয় করে?’
.
Next page 3নিয়ে আসা হতো−আমরা সুরা মুখস্থ
করতে করতে দেখতাম রোগীকে গাছের
সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে−আর সন্ধ্যার
পর চিকিৎসার নামে শুরু হতো অত্যাচার।
সব মিলিয়ে একেবারে ভয়াবহ ব্যাপার!
এক কোরবানির ঈদের ঘটনা। ঈদের
আগে মাদ্রাসায় ছুটি হয়েছে। মাদ্রাসার
সবাই চলে গেছে,
রয়ে গেছি খালি আমি আর মতিন।
মতিনের বাড়িতে কেউ নেই, রোজা-রমজান
বা ঈদের ছুটিছাটাতেও সে মাদ্রাসায়থাকে।
আমার বাড়ি অনেক দুর−গয়না নৌকার
সঙ্গে যোগাযোগ করে যেতে হবে, সে জন্য
দেরি হচ্ছে। হুজুর করিমুল্লার
বাসা মাদ্রাসার সঙ্গে লাগানো,
সেখানে হুজুর তাঁর দুই বিবি নিয়ে থাকেন।
সেই বিবিরা খুব পর্দানশিন।
আমরা কখনো দেখি নাই।পরপুরুষদের
মহিলাদের গলার আওয়াজ শোনা ঠিক না;
কিন্তু আমরাশুনতাম দুই বিবি ক্যাট
ক্যাট করে রাতদিন ঝগড়া করছে।
হুজুর
খেপে গিয়ে মাঝেমধ্যে তাঁর দুই
বিবিকে শাসন করতেন, সেটা ছিল
আরওভয়াবহ ব্যাপার।
একদিন হুজুর করিমুল্লা তাঁর এক
বিবিকে বাপের
বাড়িতে রেখে আরেকবিবিকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেছেন।
আমার আর মতিনের ওপর
পুরো মাদ্রাসার দায়িত্ব। হুজুর
ফিরেএলে আমরা বাড়ি যাব।
পুরো মাদ্রাসা খালি, গাছপালায়
ঢাকা পুরোনো দালান, দিনের বেলাতেই
অন্ধকার হয়ে থাকে। যখন অন্য
ছাত্ররা ছিল, ভয়ডর করে নাই; কিন্তু
একা কেমন জানি গা ছম ছম করে। মতিন
ছিল বদমাইশের ঝাড়, দিনরাত খালি জিন-
ভুতের গল্প করে ভয় দেখাত।
আমি যে দিনের কথা বলছি সে দিন
দুপুরবেলা দুরের কোনো একটা গ্রাম
থেকে দুইজন মানুষ
জিনে পাওয়া একটা রোগী নিয়ে এসেছে হুজুরের
কাছে। যখন শুনল হুজুর নেই, তখন
তারা একটু বিপদে পড়ে গেল
−রোগী নিয়ে থাকবে না চলে যাবে বুঝতে পারছে না।
আমরা জিন-ভুতের রোগী দেখে অভ্যস্ত।
রোগীগুলোর মধ্যে একটা মিল ...
...থাকে। সবাই কেমন যেন ভয়ের
মধ্যে থাকে, হাত-পা কাঁপে,
ভালো করে হাঁটতে পারে না, বিড়বিড়
করে কথা বলে হাউমাউ করে কাঁদে। কিন্তু
এই রোগীটা একেবারে অন্য রকম।
দেখে মনে হয় পুরো স্বাভাবিক। রোগীর
বয়স বেশি না, ২৩-২৪ বছর। গায়ের
রং ফরসা, মাথার চুলগুলো একটু লম্বা। ।
দেখেমনে হয় যাত্রাদলে অভিনয় করে।
পায়জামা আর শার্ট পরে আছে,
শরীরে একটা চাদর জড়ানো।
মানুষটা বেশি কথা বলে না,
কিন্তুকী রকম জানি মেরুদন্ড
সোজা করে শক্ত হয়ে বসে থেকে শুধু
এদিক-সেদিক তাকায়। চোখের
দৃষ্টিটা একটু অন্য রকম, চোখে চোখ
পড়লে কেমন জানি বুক কেঁপে ওঠে।
মতিন সঙ্গের মানুষ দুইজনকে জিজ্ঞেস
করল, ‘এই আপনাদের রোগী?’
মানুষ দুইজন মাথা নাড়ল। আমি বললাম,
‘দেখে তো কোনো সমস্যা আছে মনে হয়
না।’
আমার কথা শুনে রোগী দাঁত বের
করেহাসল, দাঁতগুলো লালচে দেখে কেমন
যেন অস্বস্তি লাগে। মতিন বলল,
‘রোগীর কোনো সমস্যা নেই। নিয়ে যান।’
আমি বললাম, ‘হুজুর আসবে পরশু
দিন,তখন আসবেন।’
সঙ্গের দুইজন মানুষ নিজেদের
মধ্যে বিড়বিড় করে কী যেন কথা বলে,
আমাদের কিছু বলে না। একটু পর
দেখি রোগীকে রেখে মানুষ দুইজন
পালিয়ে গেছে। আমি আর মতিন তখন
রোগীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম।
মতিন মানুষটাকে জিজ্ঞেস করল,
‘আপনার সঙ্গে দুইজনকই?’
মানুষটা তার লাল দাঁত বের করে হাসার
মতো ভঙ্গি করে বলল, ‘চলে গেছে।’
‘কোথায় চলে গেছে।’
‘মনে হয় বাড়ি চলে গেছে।’
‘আপনাকে রেখে বাড়ি চলে গেছে?’
মানুষটা মাথা নাড়াল। বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘কেন?’
‘ভয় পায় তো সেই জন্য।’
‘আপনাকে ভয় পায়?’
http://joshim.wapdale.com
‘হ্যাঁ।’
‘কেন? আপনাকে দেখে তো ভয় পাওয়ার
কিছু আছে বলে মনে হয় না?’
মানুষটা কোনো কথা না বলে এদিক-সেদিক
তাকাল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আছে?’
‘এখন নাই। তবে−’
‘তবে কী?’
‘রাতে যখন ও আসবে−’
‘কে আসবে?’
...‘ও।’
‘ও-টা কে?’
মানুষটা কথার উত্তর
না দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। মতিন
তখনএকটু রেগে উঠে বলল, ‘আপনি এখন
যান। আপনার সঙ্গে যারা আসছে তাদের
সঙ্গে বাড়ি যান।’
মানুষটা এমন একটা ভাব করল যেন
মতিনের কথা শুনতেই পায় নাই। মতিন
তখন গলা উঁচিয়ে ধমক দিয়ে বলল, ‘যান।
বাড়ি যান।’
মানুষটা মাথা নাড়ল। বলল, ‘নাহ্।যাব
না।’
‘যাবেন না?’
‘না।’
‘কেন যাবেন না?’
‘জায়গাটা ভালো, আমার পছন্দ হয়েছে।’
‘পছন্দ হয়েছে?’
‘হ্যাঁ। অন্ধকার, লোকজন বেশি নেই।
নিরিবিলি। ও যখন আসে,
লোকজনথাকলে রাগ হয়।’
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘ও-
টা কে?’
মানুষটা আমার কথার উত্তর দিল না।
চাদর মুড়ি দিয়ে চুপচাপ বসে রইল।
মতিন জিজ্ঞেস করল, ‘ও কেন আসে?’
‘খিদে পায় তো, তাই খেতে আসে।’
‘কী খায়?’
‘রক্ত খায়।’
শুনে আমরা দুইজনই চমকে উঠলাম, ‘রক্ত
খায়?’
মানুষটা তার দাঁত বের করে হাসল,
দাঁতগুলো লাল। এবারে আমার গা ঘিন ঘিন
করতে লাগল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিসের
রক্ত?’
‘যখন যেটা পায
গরু-ছাগল।’ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘মানুষ।’
আমি চিৎকার করে বললাম, ‘মানুষ?’
মানুষটা কোনো কথা না বলে আমার
দিকে তাকিয়ে থাকে, তার চোখের
দৃষ্টি দেখে আমার হাত-
পা ঠান্ডা হয়ে গেল।
আমি আর মতিন নিজেদের মধ্যে পরামর্শ
করতে বসলাম। মতিন বলল, ‘এই
লোকরে এইখানে রাখা যাবে না।’
আমি বললাম, ‘না। দিনের বেলাতেই
দেখে এত ভয় লাগে, রাতে কী হবে?’
মতিন বলল, ‘আজ আবার অমাবস্যা।’
আমি বললাম, ‘চল, মানুষটাকে বের
করে দেই।’
মতিন জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় বের
করে দিবি?’
‘ধরে নিয়ে বাজারে ছেড়ে দিব।’
আমার পরামর্শটা মতিনের পছন্দ হলো।
বলল, ঠিক আছে।
আমি আর মতিন তখন গেলাম
মানুষটাকে ধরে বের করে দিতে,
গিয়ে দেখি মানুষটা নেই।
চারদিকে গাছগাছালি, ঝোপঝাড়।
মাদ্রাসার ..
...ভাঙা দালানের মধ্যে কেউ
যদি লুকিয়ে থাকে, তাকে খুঁজে বের
করা অসম্ভব ব্যাপার। তবুও আমি আর
মতিন চেষ্টা করলাম, কোনো লাভ
হলো না।
রাতের
বেলা আমরা তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছি।
আলো কমিয়েহারিকেনটা মাথার
কাছে রেখেছি, ঘরের
ভেতরে আবছা অন্ধকার।
বাইরেঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে, গাছের পাতার
শরশর একরকম শব্দ হচ্ছে।
কাছাকাছি কোথা থেকে জানি শেয়ালডাকল,
চলবে..
কাছাকাছি কোথা থেকে জানি শেয়ালডাকল,
শেয়ালের ডাক খুব ভয়ের
−মনে হয়একটা খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
শেয়ালের ডাকটা শেষ হওয়ার
সঙ্গে সঙ্গে আমরা শুনলাম, উঁ উঁ
করে কে যেন কান্নার মতো শব্দ করছে।
প্রথমে আস্তে আস্তে, তার পরে একটু
জোরে। একটু পরে আরও জোরে।
আমি আর মতিন দুইজনেই তখন বিছানায়
উঠে বসলাম। মতিন জিজ্ঞেস করল,
‘কে? কে কাঁদে?
আমি বললাম, ‘ওই মানুষটা হবে নিশ্চয়ই।’
‘কোথায় আছে দেখবি?’
আমি বললাম, ‘যদি কিছু করে?’
‘কী করবে? আমরা দুইজন আছি না?’
সেটা অবশ্য সত্যি কথা, আমরা দুইজন,
পনেরো-ষোল বছর বয়স। গ্রামের ছেলে,
হাট্টাকাট্টা জওয়ান আমাদের কী করবে?
খুঁজে খুঁজে ঘরের ভেতর
থেকে দুইটা লাঠি বের
করে হারিকেনটা হাতে নিয়ে বের হলাম।
ঘর থেকে বের হতেই শব্দটা থেমে গেল।
একটু পরে আবার শুরু হলো।
প্রথমে আস্তে, তার পরে একটু জোরে।
শব্দটা শুনতে শুনতে আমরা এগিয়ে যাই,
দালানটার শেষ মাথায় একটা ছোট ঘর,
পুরোনো বই-খাতা জঞ্জাল দিয়েভরা,
মনে হচ্ছে শব্দটা সেখান থেকে আসছে।
আমরা ঘরটার
দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকে একেবারে হকচকিয়ে গেলাম।
ঘরের জঞ্জাল পরিষ্ককার
করে সেখানে সাদা চাদরটা বিছিয়ে মানুষটা উদোম
হয়ে শুয়ে আছে−দুই হাত, দুই
পা লম্বা া করে ছড়িয়ে রেখেছে। তার মুখ
ঘামে ভেজা আর সেখান থেকে কান্নার
মতো শব্দ বের হচ্ছে।
মতিন জিজ্ঞেস করল, ‘কী হচ্ছে?
কী হচ্ছে এখানে?’
মানুষটা ভাঙা গলায় বলল, ‘ভয় করে।
আমার ভয় করে।’
‘কী ভয় করে?’
‘ওরে ভয় করে।’
‘কেন ভয় করে?’
.